আহলেহাদীছ আক্বীদা বনাম খারেজী আক্বীদা


আহলেহাদীছ আক্বীদা বনাম খারেজী আক্বীদা

আক্বীদা ' হল মুসলিম জীবনের মৌল ভিত্তি । ইসলামের বিধি - বিধান সংক্রান্ত বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাসই সফলতা - বিফলতার মূল চাবিকাঠি । আক্বীদা বিশুদ্ধ হলে মুমিন জীবনের কথা , কর্ম সবকিছুই আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে এবং চূড়ান্ত প্রতিদানে আখেরাতে ধন্য হবে । পক্ষান্তরে আক্বীদায় সামান্যতম ত্রুটি থাকলে আল্লাহর শানে কোন কিছুই গৃহীত হবে না । ফলে পারলৌকিক জীবন চরমভাবে বিপর্যস্ত হতে হবে । তাছাড়া এ আকীদার কারণে পার্থিব জীবনেও নেমে আসে নানা রকম বিপর্যয় ।
আল্লাহ তাআলা বলেন , وَمَن يَكْفُرْ بِالْإِيمٰنِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُۥ وَهُوَ فِى الْءَاخِرَةِ مِنَ الْخٰسِرِينَ
"যে বিশ্বাসের সাথে কুফরী করবে তার আমল ধ্বংস হয়ে যাবে । সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে ’( মায়ােদহ ৫ ) ।

শায়খ আব্দুল আযীয ইবনু আব্দুল্লাহ বিন বায ( রহঃ ) উক্ত আয়াতের আলােকে বলেন ,
معلوم بالعدل التي الشريعه من الكتاب والسنه ان الاعمال والاقوال انما تصيح وتقبلوا اذا صدرت عن عقيدته غير الصحيحه باطالَ ما يتفرع عنها
শারঈ বিধি - বিধান তথা কুরআন - সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে , যাবতীয় আমল ও কথা তখনই কেবল বিশুদ্ধ হয় এবং আল্লাহর নিকট গৃহীত হয় , যখন তা বিশুদ্ধ আক্বীদার মাধ্যমে উৎসারিত হয় । আর যদি আক্বীদা বিশুদ্ধ না হয় তবে আমল , কথা সবকিছুই বাতিল বলে গণ্য হয় ' । ।
অতএব আক্বীদা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । অথচ এ ব্যাপারে অধিকাংশ লােকই উদাসীন । মুসলিম উম্মাহ্র বিভক্তি , বিভ্রান্তি ও বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ হল এই আক্বীদা । এজন্য বলা হয় , ' বিশুদ্ধ আক্বীদা দ্বীন ইসলামের মূল এবং মুসলিম মিল্লাতের সুদৃঢ় ভিত্তি ' ভিত্তি,
العقيده الصحيحه هي اصل دين الاسلام و اساس الملتي
বিশুদ্ধ আক্বীদার মানদণ্ডে আহলেহাদীছগণের আক্বীদাই নির্ভেজাল ও সর্বাধিক বিশুদ্ধ ।

নিম্নে আহলেহাদীছদের আক্বীদার সাথে চরমপন্থী খারেজী আক্বীদার পার্থক্যের কয়েকটি মৌলিক দিক তুলে ধরা হলঃ
( ১ ) খারেজীদের আক্বীদাহ হল - হৃদয়ে বিশ্বাস মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়ন তিনটিই ঈমানের মূল ও অবিচ্ছিন্ন অংশ । এজন্য তারা কাবীরা গােনাহগার ব্যক্তিকে ঈমানহীন কাফের মনে করে ।
পক্ষান্তরে আহলেহাদীছগণের আক্বীদাহ হল, - হৃদয়ে বিশ্বাস , মুখে স্বীকৃতি মূল আর আমল তার শাখা । এজন্য তাঁদের মতে কেউ কাবীরা গােনাহ করলে তার ঈমান হ্রাসপ্রাপ্ত হয় , কিন্তু কাফের হয়ে যায় না ।
( ২ ) চরমপন্থীদের মতে ঈমানের হ্রাস - বৃদ্ধি নেই ।
আহলেহাদীছগণের আক্বীদা হল , সৎ আমলের মাধ্যমে ঈমান বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় । পক্ষান্তরে এবং পাপকার্যে হ্রাসপ্রাপ্ত হয় ।
( ৩ ) তাদের মতে কাবীরা গােনাহগার ব্যক্তি কাফের হওয়ায় হত্যাযযাগ্য অপরাধী এবং তওবা না করে মারা গেলে চিরস্থায়ী জাহান্নামী ।
পক্ষান্তরে আহলেহাদীছগণের মতে - এমন ব্যক্তির ঈমান হাসপ্রাপ্ত হয় । এমনকি গােনাহের ধারা অব্যাহত থাকায় ঈমান শূন্য হলেও সে ইসলাম থেকে খারিজ নয় । তাই সে কাফেরও নয় , হত্যাযযােগ্য অপরাধীও নয় । তওবা না করে মারা । গেলেও চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয় । পাপের প্রায়শ্চিত্য ভােগের পর কালেমা ত্বইয়েবার বদৌলতে এক সময় সে জান্নাতে প্রবেশ করবে । তাকে যেমন পূর্ণ মুমিন বলা যাবে না , তেমনি কাফেরও বলা যাবে না । তবে ফাসিকৃ গােনাহগার বলা যাবে ।
( ৪ ) খারেজীদের মতে , ওছমান ও আলী ( রাঃ ) সহ তাদের হাতে বায় ' আতকারী সকল ছাহাবী কাফের । ছিফফিনের যুদ্ধে আলী ও মু ' আবিয়া । ( রাঃ ) উভয়ের পক্ষে যারা অংশ গ্রহণ করেছিলেন , যারা তাদের সন্ধিতে সন্তুষ্ট । ছিলেন বা আজও আছেন এবং যারা তাদের বিরােধিতা করে থাকে তারা সকলেই কাফের , তাদের রক্তও হালাল ।
” আহলেহাদীছগণ উক্ত আক্বীদাকে কুফরী আক্বীদা বলে বিশ্বাস করেন ।

আলী ও মু'আবিয়া ( রাঃ ) - এর মাঝের দ্বন্দ্বকে তারা ইহুদীদের সূক্ষ্ম চক্রান্তের ফসল মনে করেন । তারা এক পক্ষকে মুমিন অন্য পক্ষকে মহা অপরাধী বা উভয় পক্ষের নিহতদের কাউকে শহীদ কাউকে কাফের বলেন না । তাদের নিকট আহলে বায়ত সহ সকল ছাহাবা : পরম শ্রদ্ধার পাত্র । তারা তাদের সমালােচনা হতে বিরত থাকেন , বরং একে গুনাহে কাবীরা মনে করেন । ছাহাবীদের সম্পর্কে সকল বাড়াবাড়ি হতে আহলেহাদীছগণ সম্পূর্ণ মুক্ত ।
( ৫ ) খারেজী চরমপন্থীরা গােনাহগার শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা , সশস্ত্র সংগ্রাম করা ওয়াজিব মনে করে এবং শাসক সহ তার সমর্থক প্রজা সাধারণের রক্ত হালাল মনে করে ।
পক্ষান্তরে আহলেহাদীছগণ উক্ত আক্বীদাকে ভ্রান্ত বলে প্রত্যাখ্যান করেন । তাদের মতে যাবতীয় ন্যায় কাজে শাসকের আনুগত্য করতে হবে । এমন গােনাহগার শাসকের উদ্দেশ্যে সদুপদেশ দিতে হবে ,
সংশােধনের জন্য তার উদ্দেশ্যে হক কথা বলতে হবে , অপসন্দীয় হলে ধৈর্যধারণ করতে হবে, এবং তাঁর হেদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে দু ' আ করতে হবে ।
আন্তরিক ও বাহ্যিকভাবে প্রকাশ্য কুফরী প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত কোন মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না । এক্ষেত্রে তাঁরা । সরাসরি সালাফীদের পন্থা অনুসরণ করেন ।
( ৬ ) চরমপন্থীরা নিজস্ব জ্ঞান দ্বারা কুরআন - হাদীছের মনগড়া ব্যাখ্যা করে । তারা রাসূল ( ছাঃ ) ও ছাহাবায়ে কেরাম , সালাফে ছালেহীনের ব্যাখ্যার প্রতি । মােটেই ভ্রুক্ষেপ করে না । ইবনু আব্বাস ( রাঃ ) , ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ , ইবনুল কাইয়িম ( রহঃ ) প্রমুখ বিদ্বানগণ উক্ত মত ব্যক্ত করেছেন ।
পক্ষান্তরে আহলেহাদীছগণ কখনাে কুরআন - সুন্নাহ্র মনগড়া ব্যাখ্যা করেন না । তারা । এক্ষেত্রে রাসূল ( ছাঃ ) , ছাহাবায়ে কেরাম , সালাফে ছালেহিনের ব্যাখ্যাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন । তাঁদের ব্যাখ্যার সাথে যদি কোন বিদ্বানের ব্যাখ্যা সাংঘর্ষিক হয় , তাহলে ঐ বিদ্বানের ব্যাখ্যাকে নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করেন ।
( ৭ ) খারেজীদের মৌলিক উদ্দেশ্য হল - যে কোন পন্থায় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা ।

পক্ষান্তরে আহলেহাদীছগনের মৌলিক উদ্দেশ্য হল -
ব্যক্তির আক্বীদা সংশােধনের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক সংস্কার সাধন করা , যা ছিল নবী রাসূলগণের মৌলিক উদ্দেশ্য । তবে তাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতাকে এজন্য সহায়ক ও পরিপূরক মনে করেন । তাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জনকে সম্পূর্ণ আল্লাহর উপরে ছেড়ে দেন ( সূরা নূর ৫৫ )
এবং এটা পাওয়াকে দুনিয়াবী অতিরিক্ত সফলতা মনে করেন ( সূরা ছফ ১৩ ) । আর আখেরাতের সফলতাকেই চূড়ান্ত ও মৌলিক সফলতা বলে মনেপ্রাণে আক্বীদা পােষণ করে থাকেন ( সূরা ছফ ১১ , ১২ ) ।

চরমপন্থী খারেজীদের উক্ত আক্বীদার সাথে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা ' আত আহলেহাদীছদের আক্বীদার কোনরূপ সম্পর্ক নেই , বরং সম্পূর্ণ বিপরীত ।
এমনকি শাখা - প্রশাখার দিক থেকেও কোন মিল নেই । আহলেহাদীছদের মতে কেউ কোন কুফরী কাজ করলেই তৎক্ষণাৎ কাফের হয়ে যায় না , বরং সে ফাসেকৃ , যালেম কিংবা পাপী সাব্যস্ত হয় ।

ইমাম ইবনু হাযম আন্দালুসী ( ৩৮৪ - ৪৫৬ হিঃ ) বলেন,
وَأماَّ ناحنُ فَنَقُولُ إنَّ کُلَّ مَن کَفَرَ فَھُوَفَسِقؒ ظَالِمؒ عاَصِیؒ وَلَيسَ کُلُّ فاسِقؑ ظالِمٍ عاصٍ کافِرً ا بل قد یاکُونُ موٴمِناً باِللّٰهِ التَّوفيقِ
‘ আমরা বলি প্রত্যেকেই যারা কুফরী করে তার ফাসেকৃ , যালেম , পাপী । আর প্রত্যেক ফাসেকৃ , যালেম পাপী কাফের নয় , বরং আল্লাহ্র মর্জি অনুযায়ী কিছুটা হলেও মুমিন থাকে ' ।

আহলেহাদীছদের মতে - কাবীরা গােনাহগার ব্যক্তি ফাসেকৃ বা অপূর্ণাঙ্গ মুমিন । পাপের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকায় ঈমান শূন্য হলেও সে ইসলাম থেকে খারিজ নয় এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামীও নয় ।
জাহান্নামে পাপের শাস্তি ভােগের পর কালেমা তাইয়েবার বরকতে এক সময় সে জান্নাতে যাবে । আহলেহাদীছগণ উক্ত আক্বীদার কারণে যে কোন প্রকার অপরাধের বিরুদ্ধে ।শারঈ বিধানের আলােকেই চূড়ান্ত ফায়ছালা পেশ করে থাকেন ।
নিজস্ব প্রবৃত্তির আলােকে কোন সিদ্ধান্ত পেশ করেন না । যারা অন্যায়ভাবে মানুষ । হত্যা করে তাদের বিরুদ্ধে হত্যার বদলে হত্যা , খুনের বদলে খুন আল্লাহর এই বিধানের আলােকে রক্ত হালাল মনে করেন ( বাক্বারাহ ১৭৮ )

অনুরূপভাবে । যতক্ষণ কেউ আন্তরিক ও বাহ্যিকভাবে ইসলামী শরীআতকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে কাফের না হবে এবং ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করে অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করে মুরতাদ না হবে , ততক্ষণ তারা কারাে জান - মাল হালাল মনে করেন না ।

তবে এ সমস্ত বিধান বাস্তবায়ন করবে দেশের সরকার । কারাে পক্ষে নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার অধিকার ইসলামে নেই ।

আল্লাহ আমাদের সঠিক বুজার তৌফিক দান করুন। (আমিন)

No comments

Theme images by konradlew. Powered by Blogger.