কারও ভালো কাজের উদ্যমতা কি তার মানহাজ বিশুদ্ধ হওয়ার মানদণ্ড?

Image may contain: sky and text

কারও ভালো কাজের উদ্যমতা কি তার মানহাজ বিশুদ্ধ হওয়ার মানদণ্ড?
·
সম্প্রতি জনৈক মুসলিম ভাই—যিনি একজন যশস্বী ব্যক্তি এবং ‘সালাফীদের প্রতি হিতাকাঙ্ক্ষী’ দাবিদার—হঠাৎ তাঁর এক পোস্টে বলেছেন, ‘সালাফীদের অধিকাংশই তাকফীরী।’ তাঁর এই কথাটি মোটেই সহজসরল বা সাদামাটা নয়, বরং খুবই সাঙ্ঘাতিক কথা এবং একটি বড়সড় জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অপবাদ। আর একারণে এই ইস্যুতে আমাদের এক ভাই তাঁর আপত্তি ও অভিযোগের জবাবস্বরূপ একটি পোস্ট লিখেছেন। এরই জের ধরে আমাদের আলোচ্য যশস্বী ভাইটির জনৈক ভক্ত এই রদমূলক পোস্টের জবাবে একটি পোস্ট লিখেছেন এবং এ সম্পর্কে স্পষ্টতই ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছেন। ভক্ত সাহেবের পোস্ট ও কমেন্টস পড়ে উপলব্ধি করলাম, সালাফী মানহাজের ব্যাপারে কিছু ভাই চরম ভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন। এরকম কিছু ভ্রান্তির অপনোদনের জন্যই এই লেখাটির অবতারণা। ওয়া বিল্লাহিত তাওফীক্ব।

কতিপয় ব্যক্তির ধারণা, অমুক ব্যক্তির এত ভালো কাজ আছে, ইসলামের জন্য তাঁর এত নিরলস প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম রয়েছে, তাঁর মানহাজ আবার অশুদ্ধ হয় কী করে?! একজন ব্যক্তি কতগুলো ইসলামী বই লিখেছে, কতজনকে মুসলিম বানিয়েছে, কতজন দরিদ্রকে সাবলম্বী করেছে, কতজনকে আল্লাহমুখী করেছে—এগুলোর কিছুই তার মানহাজ বিশুদ্ধ হওয়ার মানদণ্ড নয়। বরং ব্যক্তি সালাফিয়্যাহ’র মূলনীতিগুলো মানছে কি না তার ওপর তার মানহাজের বিশুদ্ধতা নির্ভর করে।
·
আসুন, মানহাজের বিশুদ্ধতা কীসের ওপর নির্ভর করে, তা আহলুস সুন্নাহ’র প্রখ্যাত ‘আলিমগণের বক্তব্য থেকেই জেনে নিই। প্রখ্যাত ফাক্বীহ, মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও উসূলবিদ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম ‘উবাইদ বিন ‘আব্দুল্লাহ আল জাবিরী (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৭ হি.] কে প্রশ্ন করা হয়েছে, “কখন একজন ব্যক্তি সালাফী মানহাজ থেকে বেরিয়ে যায়? আর কখন তার উপর এই হুকুম লাগানো যায় যে, সে সালাফী না?”


তিনি (হাফিযাহুল্লাহ) উত্তরে বলেছেন, “ ‘আলিমগণ এই বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এবং তাঁদের গ্রন্থ ও নসিহতসমূহে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। এটা তাঁদের মানহাজেরই অন্তর্ভুক্ত। আর তা হলো—ওই ব্যক্তি সালাফিয়্যাহ থেকে বেরিয়ে যাবে, যখন সে আহলুস সুন্নাহ’র মূলনীতিসমূহের কোনো একটি মূলনীতির বিরোধিতা করবে। আর তার উপর এ ব্যাপারে দলিল প্রতিষ্ঠা (হুজ্জত কায়েম) করা সত্ত্বেও সে যদি (তার ভ্রষ্টতা) থেকে ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে, তাহলে সে সালাফিয়্যাহ থেকে বেরিয়ে যাবে।” [ইমাম ‘উবাইদ আল-জাবিরী (হাফিযাহুল্লাহ), জিনায়াতুত তামায়ু‘ঈ ‘আলাল মানহাজিস সালাফী; পৃষ্ঠা: ৪৯; আল-মীরাসুন নাবাউয়ী, আলজিয়ার্স কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪৩৩ হি./২০১২ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]

ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] কে প্রশ্ন করা হয়েছে, “আহলুস সুন্নাহ’র একজন ‘আলিম যদি বিদ‘আতীদের সাথে ‘আক্বীদাহর কোনো একটি মাসআলাহ’য় একমত হয়, তাহলে কি তিনি তাদের (বিদ‘আতীদের) একজন হিসেবেই গণ্য হবেন?” তিনি (হাফিযাহুল্লাহ) উত্তরে বলেছেন, “হ্যা; সে যদি ‘আক্বীদাহর মাসায়েল ও ‘আক্বীদাহর মূলনীতির কোনো একটি মাসআলাহ’য় তাদের সাথে একমত হয়, তবে সে বিদ‘আতী হয়ে যাবে।” [দ্র.: www.youtube.com/watch?v=4gJJZ2IQH9Q]
·
ভালো কাজের উদ্যমতাকে যারা ব্যক্তির মানহাজ বিশুদ্ধ হওয়ার মানদণ্ড হিসেবে উল্লেখ করছেন, তাঁদেরকে বলছি, এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা। সালাফী মানহাজের অগ্রবর্তী সেনানী ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ)’র যুগে হারিস আল-মুহাসিবী নামক বিদ‘আতী ছিল। সে এত চমৎকার কথা বলত, দুনিয়াবিমুখতার ব্যাপারে এমন হৃদয় গলানো বক্তৃতা দিত যে, তার বক্তব্য শুনে শ্রোতার চোখে অশ্রুর জোয়ার আসত। স্বয়ং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর বক্তব্য শুনে কেঁদে ফেলেছেন। এতৎসত্ত্বেও ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) হারিসের সাহচর্য থেকে সতর্ক করেছেন। কারণ হারিস ছিল বিদ‘আতী, তার মানহাজ ছিল গলত। অনুরূপভাবে আমাদের ‘আলিম ও ইমামগণ এমন অসংখ্য লোককে বিদ‘আতী বলেছেন, যাদের প্রচুর বেনিফিশিয়াল এফোর্ট ছিল।


বর্তমান যুগের কথা যদি বলি, বেশিদূর যাব না, বাংলাদেশের কথাই বলি। মৌলবি জসীমুদ্দীন রহমানী (হাদাহুল্লাহ)। এই লোকের বক্তব্যে পীর-মুরীদীর ব্যবসা লাটে উঠে গিয়েছিল। শির্ক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থান রয়েছে। কিন্তু এই লোক সাইয়্যিদ কুতুবের মতো গ্রেটেস্ট বিদ‘আতীর দা‘ওয়াতকে সঠিক আখ্যা দিয়েছে, প্রকাশ্যে মুসলিম শাসকের সমালোচনা করেছে, সৌদি শাসককে তাগূত ফাতওয়া দিয়েছে এবং মাদানী দা‘ঈদেরকে তাকফীরী বলে জঘন্য অপবাদ দিয়েছে। একারণে সে একটা ভ্রষ্ট বিদ‘আতী দা‘ঈ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং উস্তায মতিউর রহমান মাদানী (হাফিযাহুল্লাহ) তাকে খারিজী ফাতওয়াও দিয়েছেন।
·
আবার অনেকে এই ধারণা করে বসে আছেন যে, কেউ সালাফী ‘আলিম কিংবা ত্বালিবদের সান্নিধ্যে থেকে পড়াশোনা করলেই সে সালাফী মানহাজ অবলম্বনকারী বলে গণ্য হয়। যেন তার মানহাজ সঠিক ও বিশুদ্ধ, বিন্দুমাত্র প্রমাদও তার মানহাজে নেই। এটাও পূর্বোক্ত ধারণাটির মতো ভুল ও অলীক ধারণা। বলাবাহুল্য এই ধারণাপ্রসূত কথাবার্তা সেসব ভাইদের কাছ থেকে কখনো আসে না, যাঁরা কিছু হলেও সালাফী মানহাজ অধ্যয়ন করেছেন এবং ভ্রান্ত মানহাজ সম্পর্কে কিছু হলেও জানেন।


মু‘তাযিলাহ ফিরক্বাহ’র জনক ওয়াসিল ইবনু ‘আত্বা। সে প্রখ্যাত তাবি‘ঈ ইমাম হাসান বাসরী (রাহিমাহুল্লাহ)’র ছাত্র ছিল। কাবীরাহ গুনাহগার মু’মিনদের ব্যাপারে তার ভ্রান্ত বিশ্বাসের সাথে ইমাম হাসান বাসরীর কথা সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় সে তাঁর মাজলিস ত্যাগ করে। এত বড়ো তাবি‘ঈ ইমামের ছাত্র হওয়ার পরেও সে ভ্রষ্ট, তার মানহাজ গলত।

এই যে ড. আরীফী। একজন সেলিব্রিটি দা‘ঈ, একাধিক বেস্টসেলার বইয়ের লেখক। যার বইয়ের বাংলা অনুবাদও হরহর করে বিক্রি হয়। যে লোক লাইভে আসলে লাখো ভিউয়ারের সমাগম হয়। যেখানে সমকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিদ্বান ইমাম সালিহ আল-ফাওযানের লাইভে কয়েকশ ভিউয়ার খুঁজে পাওয়া যায় না। যে ‘আরীফীর শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম ইবনু বায, ইমাম ‘উসাইমীন, ইমাম ‘আব্দুর রাযযাক্ব ‘আফীফী, ‘আল্লামাহ ‘আব্দুল্লাহ বিন ক্বা‘ঊদ, ‘আল্লামাহ ‘আব্দুর রাহমান বিন নাসির আল-বাররাকের মতো যুগশ্রেষ্ঠ বিদ্বান।

অথচ এই ‘আরীফী সাহেব অত্যাচারী মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বৈধ ঘোষণা করেছেন, সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়েছে—মর্মের মিথ্যা বানোয়াট কাহিনী বলে যুবকদেরকে উসকানি দিয়েছেন। একারণে ইমাম আহমাদ আন-নাজমী, ইমাম সালিহ আল-ফাওযান-সহ আরও বেশ কয়েকজন ‘আলিম তাকে বিদ‘আতী আখ্যা দিয়েছেন এবং তার থেকে সতর্ক করেছেন।
·
তো কথা হলো, কারও মানহাজ তার শিক্ষকের সালাফী হওয়ার ওপর ডিপেন্ডেড নয়। এটা অনেক বড়ো ভুল ধারণা। আসলে সালাফী মানহাজের অনুসারী হতে পারা এবং সালাফিয়্যাহ’র দিশা পাওয়া—পুরোটাই আল্লাহপ্রদত্ত উপহার। সালাফিয়্যাহ এমন এক ঈপ্সিত সুধা, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তা পান করিয়ে থাকেন। এই তো ইমাম মুহাম্মাদ হামিদ আল-ফাক্বী (রাহিমাহুল্লাহ)। যিনি আযহার ভার্সিটিতে পড়ে একজন আশ‘আরী হিসেবে গড়ে ওঠেছেন। আল্লাহ’র ইচ্ছায় একজন আহলেহাদীস চাষির মাধ্যমে তিনি সালাফিয়্যাহ’র দিশা পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ওই চাষি একজন ইমাম হওয়ার যোগ্য ছিলেন।’ সুবহানাল্লাহ।

ইমাম মুহাম্মাদ খালীল হাররাস। আল-আযহার ভার্সিটির তুখোড় ছাত্র। মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর তাঁর আশ‘আরী শিক্ষকমণ্ডলী বললেন, ‘ইবনু তাইমিয়্যাহকে রিফিউট করে পিএইচডি অভিসন্দর্ভ রচনা করো।’ তিনি ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ’র বইপুস্তক জমা করে একধার থেকে পড়া শুরু করলেন। আল্লাহ তাঁকে এই অসিলায় হিদায়াত দিয়ে দিলেন। ফলে তিনি ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহকে রিফিউট করার পরিবর্তে তাঁকে ডিফেন্ড করে তাঁর পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করলেন। আল্লাহ তাঁর ওপর রহম করুন। এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন ইমাম হাররাসের ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ আমান আল-জামী (রাহিমাহুল্লাহ)।
ইমাম জামী’র ঘটনাই বা কম কীসে! তিনি যখন ইথিওপিয়া থেকে হিজরত করে সৌদি আরবে আসেন, তখন তাঁর শিক্ষকরা বলেছিল, “খবরদার, মুহাম্মাদ বিন ‘আব্দুল ওয়াহহাবের বই পড়ো না, নতুবা ‘ওয়াহাবী’ হয়ে যাবে!” ইমাম জামী নিজে বলেছেন, “যখন শাইখ মুহাম্মাদের লেখা ‘কিতাবুত তাওহীদ’ অনেক দ্বিধায় ভুগার পর পড়া শুরু করলাম, তখন দেখলাম, পুরো বইয়ে ক্বালাল্লাহ আর ক্বালা রাসূলুল্লাহ’য় ভর্তি।” সুবহানাল্লাহ। আল্লাহ এই মহান মুহাদ্দিসের মাধ্যমে সালাফী মানহাজের অভাবনীয় খেদমত নিয়েছেন। আশ‘আরী-মাতুরীদী ও মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে সালাফিয়্যাহ’র দা‘ওয়াতে তাঁর অতুলনীয় অবদান রয়েছে।
·
আসলে একটি কথা আমরা বারবার ভুলে যাই যে, আবেগ আর যুক্তি দিয়ে ধর্ম চলে না। দ্বীন পালন করতে হলে, সালাফী মানহাজ অনুসরণ করতে হলে আবেগ আর মস্তিষ্কপ্রসূত যুক্তি শেকলবন্দী করে রাখতে হবে। সে ইসলামের জন্য এতগুলো কাজ করেছে, সে এত বড়ো ওয়েবসাইট তৈরি করে দ্বীনের খেদমত করেছে, সে এত বড়ো ‘আলিম বা ত্বালিবের সান্নিধ্যে পড়াশোনা করেছে, সে অমুক ভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছে—এসব বলে কাউকে সালাফী প্রমাণ করা যায় না। এগুলো স্রেফ বেইজলেস ডায়ালগ কিংবা লেইম লজিক ছাড়া আর কিচ্ছু না।

সালাফীদের বিরুদ্ধে তাকফীরের অভিযোগ দেওয়া, আরও ভালোভাবে বলতে গেলে সরাসরি তাকফীরী তকমা দেওয়াকে আপনি খুব সহজ মনে করেন কীভাবে? আমি অবাক হয়ে যাই! এসব কথা বলার পরও তিনি মোটেই খারাপ নন, তাঁর মানহাজে বিন্দুমাত্র ভ্রমও নেই, বরং তাঁর মানহাজ হলো সুন্দর সালীম মানহাজ! অথচ তারাই প্রচার করছেন, ‘নাম ধরে সমালোচনা করা যাবে না’, ‘নাম ধরে সমালোচনা করা সালাফদের মানহাজ না’ ইত্যাদি। অবশ্য আহলেহাদীসদেরকে তাকফীরী তকমা দেওয়াটা কিন্তু মোটেই নাম ধরে সমালোচনা না। সালাফী ভাইদের বলছি, আপনারা আসলে ভুল বুঝছেন। বুঝেন না?! তাঁরা হলেন যুগের ইমামু আহলিস সুন্নাহ। তাদের একটু আধটু ডাবল স্ট্যান্ডার্ড থাকতেই পারে!
জ্ঞাতব্য যে, নাম ধরে সমালোচনা করা যাবে না, এটা আরেক জাহালতি। এটার জবাব দেওয়ার জন্য আলাদা আর্টিকেলের দরকার আছে, গবেষণাধর্মী নিবন্ধের প্রয়োজন আছে। সুতরাং আপাতত এই প্রসঙ্গ আগামীর জন্য তোলা থাক।
·
তাকফীরী তকমা দেওয়ার ব্যাপারে আরও কিছু কথা বলি। তিনি বলেছেন, ‘আহলেহাদীসদের অধিকাংশই তাকফীরী।’ আমি বলছি, তিনি কবে জরিপ করে দেখলেন যে, আহলেহাদীসদের এত শতাংশ লোক ভিন্ন মানহাজের লোকদের তাকফীর করে বেড়ায়?! আর তাঁর এই জরিপের সাক্ষী কে? কোন এলাকার লোকদের মধ্যে তিনি এই জরিপ চালালেন? বিষয়টি আসলেই চিন্তা করার মতো। আমাদের এলাকার কথা বলি। বাড়ির পাশে যে মাসজিদ, তা হানাফী মাসজিদ। ইমাম সাহেব হানাফী। আমি বেশিরভাগ সময় এখানেই সালাত পড়ি। অনেক আহলেহাদীস এই মাসজিদে সালাত পড়েন।

আমরা আহলেহাদীসরা হানাফী ইমামের পেছনে জোরে আমীন বলি, পায়ের সাথে পা মিলিয়ে দাঁড়াই, রাফ‘উল ইয়াদাইনও করি। কৈ, কোনোদিন তো শুনলাম না, কোনো আহলেহাদীস ভাই হানাফীকে তাকফীর করছেন, অথবা কোনো হানাফী ভাই আহলেহাদীসকে তাকফীর করছেন। আরও অসংখ্য জায়গায় আহলেহাদীস ভাইয়েরা হানাফী ইমামের পেছনে সালাত পড়েন। তারা যদি তাকফীরীই হবেন, তাহলে কি কখনো হানাফী ইমামের পেছনে সালাত পড়তেন?
·
তবে কিছু অজ্ঞ লোক থাকে, যারা হয়ত নিজেদের আহলেহাদীস পরিচয় দেয়। তারা অজ্ঞতাবশত হানাফীদের তাকফীর করে বসে। এরকম অজ্ঞ লোক হানাফী দাবিদার তাবলীগীদের মধ্যেও আছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী এলাকাতেই আছে এক লোক, যে ডা. জাকির নায়েককে ডাইরেক্ট কাফির ফাতওয়া দেয়। তো একথা বলা কি আমার জন্য ন্যায়সঙ্গত হবে যে, হানাফীরা তাকফীরী কিংবা হানাফীদের অধিকাংশই তাকফীরী?! এটা তো পুরাই অপবাদ এবং জঘন্য মিথ্যাচার। উল্লেখ্য যে, আহলেহাদীসদের অধিকাংশকে তাকফীরী তকমা দেওয়া আমাদের আলোচ্য ভাইটি কিন্তু হানাফী দেওবন্দীদেরকে তাকফীরী বলেননি, শুধু আহলেহাদীসদের ব্যাপারেই একথা বলেছেন।


আল্লাহই ভালো জানেন, আমরা আহলেহাদীসরা সংখ্যায় কম বলেই তিনি আমাদের বিরুদ্ধে খড়্‌গহস্ত হয়েছেন কি না। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আমাদের আলোচ্য ভাইটি কিন্তু তাঁর এই ভিত্তিহীন কথার কারণে অ্যাপোলোজাইজ করেননি। উল্টা তাঁর এক ভক্ত কেয়ামতের দিন তাঁর ভিত্তিহীন কথার বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছে, তাদেরকে দেখে নিবেন বলে বড়ো বড়ো বুলি আউড়িয়েছেন এবং তাঁর এক পোস্টে প্রিয় ভাইয়ের ভুল ও প্রমাদ এড়িয়ে গিয়ে তাঁর কতগুলো বেনিফিশিয়াল এফোর্ট আছে, তারই চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। মানে এতবড়ো একটা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করে সেই ভাইটি যে অসংখ্য ব্যক্তিকে কষ্ট দিয়েছেন, সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। বরং স্রেফ ওই ভাইটির মিথ্যা অভিযোগের জবাব দেয়ায় সেই ভাই যে কষ্ট পেয়েছেন, সেটাই ফলাও করে প্রচার করে এবং কিছু ইমোশনাল কথাবার্তা বলে পুরো বিষয়টার মোড়ই ঘুরিয়ে দিয়েছেন ওই ভক্ত সাহেব।
·
আরেকটি বিষয়ের দিকে পাঠকবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারছি না। সালাফীদের তাকফীরী তকমা দেওয়া ভাইটির মানহাজের বিশুদ্ধতা প্রমাণ করতে যেয়ে তাঁর অনেক উপকারী কাজের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ সেই ভাইকে আরও উপকারী কাজ করার এবং পূর্ণরূপে সালাফী মানহাজ অনুসরণ করার তাওফীক্ব দিন। কিন্তু এরকম কিছু বলা হয়নি যে, সেই ভাইটি বিদ‘আতীদের বিরুদ্ধে এরকম ভূমিকা রেখেছেন, কিংবা বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ঠ বিদ‘আতীদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন।


আপনি বর্তমান পরিস্থিতির দিকে দেখেন, কয়জন লোক জানে যে, বিদ‘আতীদের রদ করা সালাফিয়্যাহ’র একটি মূলনীতি? আরে ভাই, বর্তমান সময়ে একের পর এক খারিজী আর ইখওয়ানীদের বই অনূদিত হচ্ছে, আর তাদের জোর প্রচারণা চলছে। কয়জন জানে যে, এদের মানহাজ বিশুদ্ধ নয়? কয়জন জানে যে, ইখওয়ানিজম একটা বিদ‘আতী মানহাজের নাম? আমরা তো এখনও দেখি, অসংখ্য লোক বিদ‘আতীদের সমালোচনা করাকে গিবত মনে করে। অসংখ্য লোক প্রকাশ্যে শাসকের সমালোচনা করে। এসবের ব্যাপারে ওই ভাইটির সুস্পষ্ট অবস্থান বা বক্তব্য কী—তা আমরা জানি না।
·
তাঁর মানহাজ নিয়ে কথা বলে সালাফীরা দোষ করে ফেলেছে। অথচ তিনি আহলেহাদীসদের মানহাজ নিয়ে কুৎসা রটিয়েও দোষ করেননি। তাঁকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে তো অনেক ভিত্তিহীন কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা ভিত্তিহীন নয়, প্রামাণিক কথাই বলব। নিজের মস্তিষ্কজাত কথা নয়, মানহাজের ওপর লেখা বইয়ের কথাই বলব। হাদীসশাস্ত্রের হাফিয ইমাম আবূ হাতিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২৭৭ হি.] বলেছেন, “বিদ‘আতীদের নিদর্শন হলো আহলুল আসার তথা সালাফীদের আক্রমণ করা (বা তাদের নামে কুৎসা রটানো)।” [ইমাম আবূ ‘উসমান আস-সাবূনী (রাহিমাহুল্লাহ), ‘আক্বীদাতুস সালাফ ওয়া আসহাবিল হাদীস; পৃষ্ঠা: ৩০৪; দারুল ‘আসিমাহ, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪১৯ হি./১৯৯৮ খ্রি. (২য় প্রকাশ)]


সালাফীরা এমনি এমনি তাঁর মানহাজ নিয়ে কথা বলেনি। তাদের কাছে আছে অকাট্য প্রমাণ, তাদের নিকট রয়েছে বলিষ্ঠ দলিল। সালাফীদের নামে যারা কুৎসা রটায়, যারা সালাফীদের নিন্দা করে, তাদের অন্তরে রোগ আছে, তাদের মধ্যে হঠকারিতা রয়েছে। একথা আহলুস সুন্নাহ’র ইমামদের জবানিতে সুপ্রমাণিত।

পরিশেষে বলছি, ভুল মানুষেরই হয়। আর তারাই শ্রেষ্ঠ ভুলকারী, যারা ভুল থেকে ফিরে আসে। আমি মুসলিম ভাইদেরকে উদাত্ত আহ্বান জানাব, আসুন, আমরা সালাফী মানহাজ সম্পর্কে পড়াশোনা করি, সালাফী মানহাজ সম্পর্কে জেনে তা মানার চেষ্টা করি এবং যাবতীয় জিদ ও হঠকারিতা বর্জন করে মহান রবের কাছে হকপন্থি সালাফী হওয়ার তওফীক্ব কামনা করি। প্রবাদ বাক্যটি আবারও বলছি, আল-ই‘তিরাফু বিল হাক্ব খাইরুম মিনাত তামাদী ফিল বাত্বিল, অর্থাৎ বাতিলকে আঁকড়ে ধরার চেয়ে সত্যকে মেনে নেওয়াই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। হে আল্লাহ, আপনি আমাদেরকে সালাফিয়্যাহ’য় কবুল করে নিন। আমীন, ইয়া রব্বাল ‘আলামীন।
·
সুপথপ্রাপ্তির অভিলাষী
এক গুনাহগার বান্দা—
Md Abdullah Mridha.
রচনাকাল—
বিকেল ৫ টা ৩৪ মিনিট।
মঙ্গলবার।
৩ই শা‘বান, ১৪৪০ হিজরী।
২৬ই চৈত্র, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ।
৯ই এপ্রিল, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ।

No comments

Theme images by konradlew. Powered by Blogger.