ফিকহী মাসআলার ক্ষেত্রে “এটাও ঠিক আবার ঐটাও ঠিক বলা” কি সালাফদের মানহাজ?

ফিকহী মাসআলার ক্ষেত্রে “এটাও ঠিক আবার ঐটাও ঠিক বলা” কি সালাফদের মানহাজ?

ইদানীংকালের কিছু ভাইয়ের দাবী হচ্ছে ‘ফিকহী মাসআলার ক্ষেত্রে “এটাও ঠিক আবার ঐটাও ঠিক বলা” সালাফদের মানহাজ’। অথচ এটা কখনো সালাফদের মানহাজ ছিল না এবং বর্তমান সময়ের গ্রহণযোগ্য কোন আলিমেরও মানহাজ নয়। তাদের এ ভুল-দাবীর কারণ হচ্ছে ভুল অনুবাদ ও ভুল বুঝ। তারা "اختلاف التنوع" (ইখতিলাফুত তানাওউ) শব্দের অর্থ করেছে “ফিকহী/ফুরুঈ ইখতিলাফ”। 
এটা সম্পূর্ণ ভুল অনুবাদ। আমরা কিছুক্ষণ পর এ শব্দের সংজ্ঞা উল্লেখ করব, তখন বিষয়টি স্পষ্ট হবে 
ইন শা আল্লাহ।
.
প্রথমেই আমাদের জানতে হবে “ফিকহী মাসায়িল” বলতে কী বোঝায়? দ্বীনের মাসআলাগুলো প্রধানত দুই প্রকার :
১. আকাঈদী মাসায়িল।
২. ফিকহী মাসায়িল।

“আকাঈদী মাসায়িল” বলতে আমরা সহজেই বুঝে নিতে পারি যে, যে-সব বিষয় আকীদাহর সাথে সম্পর্কিত, তা-ই আকাঈদী মাসায়িল।

আর ফিকহী মাসায়িল বলতে উদ্দেশ্য, যে-সব মাসআলা-মাসায়িল বান্দার আমলের সাথে সম্পর্কিত, যেমন - সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ্ব ইত্যাদি।
.
ফিক্বহী মাসআলাগুলোকে আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি :

১. ইজমাঈ মাসায়িল!
যে-সব মাসায়িল নিয়ে মুজতাহিদদের মধ্যে কোন ইখতিলাফ নেই, সবাই একমত।

২. ইখতিলাফী মাসায়িল।
যে-সব মাসায়িল নিয়ে মুজতাহহিদদের মধ্যে ইখতিলাফ রয়েছে।

ইখতিলাফী মাসায়িল আবার দুই প্রকার :
ক. "اختلاف التنوع" (ইখতিলাফুত তানাওউ),
খ. اختلاف التضاد (ইখতিলাফুত তাযাদ)।

উপর্যুক্ত আলোচনার ফলাফল হচ্ছে, "اختلاف التنوع" (ইখতিলাফুত তানাওউ) হল ফিকহী মাসআলার একটি অংশ বা অঙ্গ। এই প্রকার এবং এ প্রকারের দলীল দিয়ে গোটা ফিকহের ক্ষেত্রে “এটাও ঠিক আবার ঐটাও ঠিক বলা”কে সালাফদের মানহাজ দাবী করা মানে বাংলাদেশকে গোটা দুনিয়া বলা বা হাতকে একটা মানুষ বলা বা একটা মানুষকে পৃথিবীর সকল মানুষ বলার নামান্তর।
.
ফিক্বহী মাসআলার ক্ষেত্রে “এটাও ঠিক আবার ঐটাও ঠিক” তখন বলা হয়, যখন মনে করা হয় মুজতাহিদের সকল ইজতিহাদ সঠিক। আর এটা মূলত বিচ্যুত মত এবং হাদীসের খিলাফ। কারণ, রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যদি কোন মুজতাহিদ ইজতিহাদে ভুল করে, তার জন্য একটি নেকী রয়েছে আর সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছলে দ্বিগুন নেকী রয়েছে। [১] এ মতের পক্ষে রয়েছেন শুধুমাত্র ইমাম আশআরী, গাযালী ও কাযী বাকিল্লানী রাহিমাহুমুল্লাহ। এ ছাড়া সকল সালাফের মতানুযায়ী মুজতাহিদের সকল মত সঠিক নয়। [২] এ মতের কারণে অনেক ভাইয়ের দাবী “কোন মুজতাহিদ যদি কোন মাসআলার পক্ষে মত দিয়ে থাকেন, সে মাসআলাকে বিদআত বলা যাবে না।” এটাও একটা ভুল ও ভ্রান্ত কথা।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
فزوال الإثم عن المجتهد في هذه المسائل الفرعية، وحصول الأجر له لا يدل على جواز فعله هذا، ولا جواز الاقتداء به، ولا يرفع عن العمل المحدث اسم الابتداع.
মুজতাহিদ গুনাহগার হবেন না; বরং ইজতিহাদের কারণে নেকী পাবেন মানে এই নয় যে, সে আমল করা ও অনুসরণ করা বৈধ। এটাও প্রমাণ করে না যে, সে-আমল নব আবিস্কৃত হলে, তাকে বিদআত হবে না। [৩]
.
ফিকহী মাসআলার ক্ষেত্রে সব সঠিক হলে সালাফগণ ফিকহী মাসআলা-মাসায়িলের ক্ষেত্রে ‘বিদআত’ পরিভাষা ব্যবহার করতেন না, বিদআত নিয়ে মূলনীতি প্রণয়ন করতেন না, কোন ইবাদাতকে বিদআত বলতেন না এবং আমলী বিদআত সম্বলিত কোন গ্রন্থ সংকলন করতেন না। কারণ, সবই তো ঠিক। সবই ঠিক হলে বিদআত বলার অধিকার থাকে না।

ফিকহী মাসআলার ক্ষেত্রে সব সঠিক হলে কোন সালাফ বলতেন না এটা ভুল এবং এটা সঠিক। আমরা যদি ফিকহের কিতাব খুলি, তবে হয়তো এমন পৃষ্ঠা খুবই কম পাব, যেখানে সংকলক বলেননি, “এটা সঠিক”।
আমরা প্রথমে বলেছিলাম ফিকহী মাসআলা প্রথমত দুই প্রকার : ১. যে-সব মাসআলায় কোন প্রকার ইখতিলাফ নেই। এ ক্ষেত্রে কাউকে ভুল প্রমাণ করার বা ভুল বলার প্রশ্নই আসে না।

স্মর্তব্য : অনেকেই মনে করেন, এ ধরণের মাসআলা খুবই কম। এটা ভুল। এ ধরণের মাসআলা অনেক। আধুনিক সময়ে একদল গবেষক “মাওসূআতুল ইজমা” নামে ১১ খন্ডে ঐক্যমত্যপূর্ণ মাসআলাগুলো সংকলন করেছেন।

২. যে-সব মাসআলা নিয়ে ইখতিলাফ রয়েছে। এই ইখতিলাফ আবার দুই প্রকার :

ক. "اختلاف التنوع" (ইখতিলাফুত তানাওউ),
খ. اختلاف التضاد (ইখতিলাফুত তাযাদ)।

ক. "اختلاف التنوع" (ইখতিলাফুত তানাওউ) এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে :
ما كانت المخالفة فيه لا تقتضي المنافاة، ولا تقتضي إبطال أحد القولين للآخر، فيكون كل قول للآخر نوعاً لا ضداً
এমন ইখতিলাফ যা পরস্পর বিরোধী হবে না, একটি মত আরেকটি মতকে বাতিল প্রমাণ করবে না; বরং একটা আরেকটার প্রকার হবে, বিপরীত হবে না। [৪]

আরও বলা হয়েছে :
هو ما لا يكون فيه أحد الأقوال مناقضاً للأقوال الأخرى، بل كل الأقوال صحيحة
এমন ইখতিলাফ যার একটি মত অন্যটির বিপরীত হবে না; বরং সব মতই সঠিক হবে। [৫]

আরও বলা হয়েছে,
أن كل مسألة من مسائله أو نوعا من أنواعه إلا وله دليل.
এমন সব মাসআলা ও প্রকার, যার প্রতিটির পক্ষে দলীল রয়েছে। [৬]

উল্লিখিত সংজ্ঞাসমূহের আলোকে বলা যায়, "اختلاف التنوع" (ইখতিলাফুত তানাওউ) এমন বিষয় নিয়ে ইখতিলাফ যার প্রত্যেকটির পক্ষে দলীল রয়েছে, পরস্পরবিরোধী নয়। যেমন, ইকামত জোড় না বিজোড়, তাশাহুদ পড়ার পদ্ধতি, ছালাতুল খাওফের পদ্ধতি ইত্যাদি। এসব মাসআলায় উভয়পক্ষ সঠিক, কোনপক্ষকে ভুল বলা যাবে না। কারণ উভয় পদ্ধতির পক্ষে বিশুদ্ধ দলীল রয়েছে। মুজতাহিদ ইমামগণ ইখতিলাফ করেছেন বিধায় ভুল বলা যাবে না, তা নয়; প্রত্যেকের পক্ষে দলীল রয়েছে বলে ভুল বলা যাবে না। তবে এক্ষেত্রে উত্তম-অনুত্তম বলা যাবে।
.

যারা বলেছেন “এটাও ঠিক আবার ঐটাও ঠিক”, তারা মূলত এ প্রকারকে বুঝিয়েছেন, উভয়পক্ষের কাছে সহীহ দলীল থাকার কারণে। একে দলীল হিসেবে পূঁজি করে বলা যাবে না সমস্ত ফিকহী মাসআলায় এটাও ঠিক ঐটাও ঠিক।
এপ্রকারের ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, দলীল সঠিক হতে হবে। যদি দলীল সঠিক না-হয় তবে তা "اختلاف التنوع" (ইখতিলাফুত তানাওউ) নয়। যেমন, “কাবলাল জুমআ চার রাকাআত সুন্নাতের” পক্ষে কিছু হাদীস দলীল হিসেবে পেশ করা হলেও তা সঠিক দলীল নয়। তাই একে এপ্রকারে অন্তর্ভুক্ত করে বলা যাবে না যে, দু’মত সঠিক। এক্ষেত্রে সঠিক মত হচ্ছে “কাবলাল জুমআ চার রাকাআত সুন্নাত” মত সঠিক নয়। কারণ, ভুল দলীল উপস্থানের কারণেও যদি কোনকিছুকে বিদআত না-বলা যায়, তবে সালাফগণ ‘বিদআতুল ইযাফী’ নামে বিদআতকে ভাগ করতেন না।

খ. اختلاف التضاد (ইখতিলাফুত তাযাদ) এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে :
القولان المتنافيان: إما في الأصول وإما في الفروع
পরস্পরবিরোধী দু’টি মত। এটি মৌলিক মাসআলায় (আকীদায়) হতে পারে আবার শাখাগত মাসআলায়ও (ফিকহে) হতে পারে।[৭]

আরও বলা হয়েছে,
هو أن يكون كل قول من أقوال المختلفين يضاد الآخر ويحكم بخطئه أو بطلانه.
ইখতিলাফী মতগুলো পরস্পরবিরোধী হবে এবং এক মত অনুযায়ী অন্য মত ভুল বা বাতিল বলে গণ্য হবে।[৮]

এ প্রকার ইখতিলাফের উদাহরণ হচ্ছে, ওলী ছাড়া বিয়ে হবে কি না? লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওযূ ভাঙ্গবে কি না? স্ত্রীকে স্পর্শ করলে ওযূ ভাঙ্গবে কি না? ইত্যাদি।

এ প্রকারের ক্ষেত্রে বলা যাবে না “এটাও ঠিক আবার ঐটাও ঠিক বলা”। এ ক্ষেত্রে হক একটাই। কারণ, ইমাম আশআরী, গাযালী ও কাযী বাকিল্লানী রাহিমাহুমুল্লাহ ব্যতীত জুমহুরের মতে হক একটাই, একাধিক নয়।

কারো কাছে যদি দলীলের আলোকে উভয়ের যে-কোন একটি হক বলে প্রমাণিত হয়, তবে অন্যটাকে ভুল বলতে হবে। যদি কেউ বলে উভয়টি সঠিক, তবে এটি সালাফদের তরীকা থেকে বিচ্যুতি। তবে হ্যাঁ, বিরোধীপক্ষকে বিদআতী ও গোমরাহ বলা যাবে না। ইমাম নাছির-উদ-দ্বীন আল আলবানী রাহিমাহুল্লাহ আট রাকাআতের উপর তারাবীহ পড়া যাবে না বলার পর বলেন, “যখন জানতে পারলে হাদীসে বর্ণিত তারাবীর আট রাকাআতকেই আমরা যথেষ্ট মনে করি, এর উপরে বৃদ্ধি করা বৈধ মনে করি না, তার মানে এই নয় যে, পূর্বপরের যে সমস্ত আলিম আমাদের সাথে একমত নন তাদেরকে আমরা পথভ্রষ্ট অথবা বিদ‘আতী বলছি। অথচ আমাদের ব্যাপারে কিছু লোকের ধারণা এমনটাই। একে পূঁজি করে তারা আমাদের দোষারোপ করছে। তারা মনে করে কোন ব্যক্তি কোনকিছুকে বৈধ নয় বা বিদ‘আত বললেই এটা বুঝায় যে, যে ব্যক্তিই একে বৈধ বা মুস্তাহাব বলে, সে তার মতে পথভ্রষ্ট, বিদ‘আতী। এটা কক্ষনোও নয়, এটি নিছক বাতিল ধারণা ও একেবারেই অজ্ঞতা।” [৯]
কেউ দাবী করতে পারেন প্রসিদ্ধ মূলনীতি হল, “ইজতিহাদী মাসআলায় কাউকে ভুল বলা যাবে না”। ইমামগণ যে-সব মত দিয়েছেন তা তাদের ইজতিহাদ। অতএব, কাউকে ভুল বলা যাবে না।”

এটাও একটি ভুল কথা। আমাদের জানতে হবে ইজতিহাদ কোথায় চলে। প্রসিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ ফিকহী মূলনীতি হল, لا مساغ للاجتهاد في مورد النص অর্থাৎ দলীলের উপস্থিতি ইজতিহাদ করার সুযোগ নেই। তার মানে কোন মাসআলায় দলীল পাওয়া গেলেও ইজতিহাদের দোহাই দিয়ে সব মতকেই সঠিক বলা যাবে না। তবে যদি এমন কোন মাসআলায় হয় যার ব্যাপারে কোন দলীল নেই আর তার সমাধান করতে গিয়ে মুজতাহিদগণ ইজতিহাদ করার দরুন ইখতিলাফ করেন, তবে সরাসরি একপক্ষকে বাতিল বা ভুল বলা যাবে না।


❒ রেফারেন্সঃ
১. সহীহ বৃখারী, ৭৩৫২; সহীহ মুসলিম, ৭১৬
২. ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু, ১/১৩৬
৩. ইকতিযাউ সিরাতিল মুস্তাকিম, ২/৫৮০, ৫৯৯, ৬০৯, ৬৮৯; হাকীকাতুল বিদআহ ওয়া আহকামুহা ২/৬৭-৬৮ থেকে গৃহীত
৪. আল-ইখতিলাফ ওয়ামা আলা ইলাইহি, পৃ. ১৯
৫. ফিকহুল খিলাফ বাইনাল মুসলিমীন, পৃ. ১৫
৬. https://m.youtube.com/watch?v=v0CEQ8BRo58
৭. ইকতিযাউ সিরাতিল মুস্তাকিম, ১/১৩৪; শারহুল আকীদাতিত ত্বহাবিয়াহ লি-ইবনি আবিল ইয, পৃ. ৭৭৮
৮. ফিকহুল খিলাফ বাইনাল মুসলিমীন, পৃ. ২৫
৯. সলাতুত তারাবীহ, পৃ. ৩৫-৩৮
.

❒ লেখকঃ
উস্তায আব্দুল্লাহ মাহমুদ।
শিক্ষক, মাদরাসাতুল হাদিস।
নাযিরাবাজার, ঢাকা।

▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬





No comments

Theme images by konradlew. Powered by Blogger.